
আতিয়া ফাইরুজ; ১৭ জুলাই,২০২১
বুখারী শরীফের হাদিসে আছে, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বনী ইস্রাঈল গােত্রে তিনজন লােক বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিল কুষ্ঠ রােগাক্রান্ত, দ্বিতীয় জন মাথায় টাক পড়া, তৃতীয় জন অন্ধ। আল্লাহ তাআলা এই তিনজনকে পরীক্ষা করতে চাইলেন। তিনি একজন ফেরেশতা পাঠালেন। ফেরেশতা প্রথমে কুষ্ঠ রােগগ্রস্ত লােকটির কাছে গিয়ে বললেন, তুমি কি চাও ?
লােকটি উত্তর করল- “আমি আল্লাহর কাছে এই চাই যে, আমার এই কুৎসিত ব্যাধি নিরাময় হোক, আমার দেহের চমড়া নতুন রূপ ধারণ করে সুন্দর হোক— যেন আমি লােক সমাজে যেতে পারি, লােকে আমাকে ঘৃণা না করে। আমি যেন এই বালা থেকে মুক্তি পাই।”
ফেরেশতা তার শরীরে হাত বুলিয়ে দো’আ করলেন। মুহূর্তের মধ্যে তার রোগ নিরাময় হয়ে গেল। সারা শরীর নতুন রূপ ধারণ করল। তারপর আল্লাহর ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি পেতে চাও?” লােকটি বলল, “আমি উট পেলে সন্তুষ্ট হব।” ফেরেশতা তাকে একটি গর্ভবতী উটনী এনে দিলেন এবং আল্লাহর দরবারে বরকতের জন্য দো’আ করলেন।
অতঃপর ফেরেশতা টাক পড়া লোকটির কাছে গিয়ে বললেন, “তুমি কোন জিনিস পছন্দ কী?” লোকটি বলল, “আমার মাথার ব্যাধি নিরাময় হোক, যে কারণে লােক আমাকে ঘৃণা করে।” আল্লাহর ফেরেশতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ভাল হয়ে গেল। নতুন চুল গজায় নতুন রূপ ধারণ করল। তখন ফেরেশতা জিজ্ঞাসা করলেন, “কোন ধরনের জিনিস তুমি পেতে চাও?”-সে বলল, “আল্লাহ যদি আমাকে একটি গরু দান করেন, তবে আমি খুব সন্তুষ্ট হব।” ফেরেশতা একটি গর্ভবতী গাভী এনে দিলেন এবং বরকতের জন্য দু’আ করলেন।
তারপর ফেরেশতা অন্ধ লােকটির কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি চাও?”-লোকটি বলল, “আল্লাহ তাআলা আমার চোখ দুটির দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিন, যেন আমি আল্লাহর দুনিয়া দেখতে পাই। এটাই আমার আর্জি।” আল্লাহ তা’আলার ফেরেশতা তার চোখের উপর হাত বুলিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ ভাল হয়ে গেল। সে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেল।
অতঃপর ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা বলতো, কোন জিনিস তুমি পছন্দ কর?” অন্ধ বলল, “আল্লাহ যদি আমাকে একটি বকরী দান করেন, আমি খুব খুশি হব।” ফেরেশতা তৎক্ষণাৎ একটি গর্ভবতী বকরী এনে তাকে দিলেন এবং বরকতের দো’আ করে চলে গেলেন। অল্প দিনের মধ্যেই এই তিন জনের উট, গরু এবং বকরীতে মাঠ পরিপূর্ণ হয়ে গেল। তারা প্রত্যেকে এক একজন বিরাট ধনী।
অনতিকাল পরে সেই ফেরেশতা পূর্বের ছদ্মবেশ নিয়ে পুনরায় সেই উট ওয়ালার (কুষ্ঠ রোগীর) কাছে এসে বললেন, “আমি বিদেশে (দুপুরে) এসে খুবই অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। আমার বাহক জন্তুটিও মারা গেছে। আমার পথ খরচও ফুরিয়ে গেছে। আপনি যদি মেহেরবানী করে কিছু সাহায্য না করেন, তবে আমার কষ্টের সীমা থাকবে না। এক আল্লাহ ছাড়া আমি সম্পূর্ণ নিরুপায়। যে আল্লাহ আপনাকে সুন্দর স্বাস্থ্য ও সুশ্রী চেহারা দান করেছেন তার নামে আমি আপনার কাছে একটি উট প্রার্থনা করছি। আমাকে একটি উট দান করুন। আমি সেটাতে আরোহণ করে কোন প্রকারে বাড়ি যেতে পারব”।
লোকটি বলল, “হতভাগা কোথাকার! এখান থেকে দূর হও, আমার নিজেরই কত প্রয়োজন রয়েছে? তোমাকে দেবার মত কিছুই নেই।” ফেরেশতা বললেন, “আমি তােমাকে চিনি বলে মনে হচ্ছে। তুমি কি কুষ্ঠ রোগগ্রস্ত ছিলে না? লােকে কি এই রােগের কারণে তােমাকে তুচ্ছ ও ঘৃণা করতো না? তুমি কি গরীব ও নিঃস্ব ছিলে না? তারপর আল্লাহ পাক কি তােমাকে এই সম্পদ দান করেননি!
লােকটি বলল, “বাহ বাহ! কী মজার কথা বলছো! আমার বাপ-দাদার কাল হতেই বড় লােক। এই সম্পত্তি পুরুষানুক্রমে আমার ভোগদখল করে আসছি।” ফেরেশতা বললেন, “যদি তুমি মিথ্যাবাদী হও, তবে আল্লাহ তাআলা তোমাকে সেরূপ করে দিন যেরূপ তুমি পূর্বে ছিলে।” কিছুকালের মধ্যে লােকটি সর্বস্বান্ত হয়ে পূর্বাবস্থা প্রাপ্ত হল।
এরপর ফেরেশতা দ্বিতীয় ব্যক্তি অথাৎ টাক পড়া লােকটির কাছে গেলেন। লােকটির এমন সুন্দর ও সুঠাম চেহারা। মাথায় কুচকুচে কাল চুল, যেন তার কোন রােগই ছিল না। ফেরেশতা তার কাছে একটি গাভী চাইলেন। কিন্তু সেও উটওয়ালার ন্যায়ই “না” সূচক শব্দে জবাব দিল। ফেরেশতাও তাকে বদ-দুআ দিয়ে বললেন, “যদি তুমি মিথ্যুক হও, তবে আল্লাহ তা’আলা যেন তােমার সেই পূর্বাবস্থায় ফিরিয়া দেন।” ফেরেশতার দো’আ ব্যর্থ হবার নয়। তার মাথায় টাক পড়া শুরু হল, সমস্ত ধন-সম্পদ শেষ হয়ে গেল।
তারপর ফেরেশতা পূর্বাকৃতিতে সেই অন্ধ ব্যক্তির কাছে গিয়ে বললেন, “বাবা আমি মুসাফির! বড়ই বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। আমার টাকা-পয়সা কিছুই নাই। আপনি সহানুভূতি ও সাহায্য না করলে আমার কোন উপায় দেখছি না। যে আল্লাহ তাআলা আপনাকে এক বিরাট সম্পত্তির মালিক করে দিয়েছেন, তার নামে আমাকে একটি বকরী দান করুন — যেন কোন প্রকারে অভাব পূরণ করে বাড়ি যেতে পারি।”
লােকটি বলল, “নিশ্চয়ই। আমি অন্ধ, দরিদ্র ও নিঃস্ব ছিলাম। আমি আমার অতীতের কথা মোটেই ভুলিনি। আল্লাহ তা’আলা শুধু নিজ রহমতে আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়াছেন। এই সব ধন সম্পদ যা কিছু দেখছেন সবই আল্লাহ তা’আলার, আমার কিছুই না। তিনিই অনুগ্রহ করে আমাকে দান করেছেন। আপনার যে কয়টি প্রয়ােজন আপনার ইচ্ছামত আপনি নিয়ে যান! যদি ইচ্ছা হয় আমার পরিবার পরিজন ও সন্তান-সন্ততির জন্য কিছু রেখেও যেতে পারেন। আল্লাহর কসম, আপনি সবগুলো নিয়েগেলেও আমি বিন্দুমাত্র অসন্তুষ্ট হব না। কারণ, এসব আল্লাহর দান।”
ফেরেশতা বললেন, “বাবা, এসব তোমারই থাকুক। আমার কিছুর প্রয়ােজন নেই, তােমাদের তিন জনের পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য ছিল; তা হয়ে গেছে। তারা দুইজন পরীক্ষায় ফেল করেছে। তাদের প্রতি আল্লাহ তাআলা অসন্তুষ্ট ও নারাজ হয়েছেন। তুমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছো। আল্লাহ তােমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন।”
উপদেশঃ
প্রিয় পাঠক! চিন্তা করুন! প্রথমােক্ত দুইজন আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া করেনি বলে দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই তাদের বিনষ্ট হয়েছে। তাদের অবস্থা কতই না শোচনীয় হয়েছে। কারণ, আল্লাহ তাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছে। তৃতীয় ব্যক্তি আল্লাহর শােকরিয়া করেছে বলে দুনিয়া ও আখেরাত সবই বহাল রয়েছে, ধন-সম্পদ কিছুই নষ্ট হয়নি। আল্লাহ তা’আলা দিয়ে ধন বুঝে মন, কেড়ে নিতে কতক্ষণ। সাধারণত মানুষ বড় হলে অতীতের কথা ভুলে যায়। এ ধরনের লােককে প্রকৃত মানুষ বলা যায় না। প্রকৃত মানুষ তারা— যারা অতীতের দুঃখ কষ্টের কথা স্মরণ করে আল্লাহর শােকর গুজারি করে।
রেফারেন্সঃ হযরত মওলানা আশরাফ আলী থানভী চিশতী (রাঃ),(২০০১)। বেহেশতী জেওর। বাংলাবাজার,ঢাকা;এমদাদিয়া পুস্তকালয় প্রকাশনী।