অযু ও নামাজের ক্ষেত্রে শয়তানের ধোঁকাসমূহ

satan in prayer

অযু ও নামাজের ক্ষেত্রে শয়তানের ধোঁকাসমূহ

আতিয়া ফাইরুজ ; ১৭ মার্চ,২০২১

নবী ও রাসূলগন দ্বীনের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ নিয়ে আগমন করেছেন যা যথেষ্ট ছিল। প্রত্যেক ব্যাধির উপযুক্ত ঔষধ বর্ণনা করে দিয়েছেন তারা; এতে কারো দ্বিমত ছিল না। এরপর ইবলিস ও শয়তান এসে পূর্ণাঙ্গ ও যথেষ্ট বিবরণের সাথে কিছু সন্দেহ সংযােজন করে দিয়েছে, উপযুক্ত ও আরোগ্য দানকারী ঔষধের সাথে কিছু বিষ মিশিয়ে দিয়েছে এবং সুস্পষ্ট পথের দুধারে বিভ্রান্তকারী ফুটপাথ সংযুক্ত করে দিয়েছে। এভাবে শয়তান রীতিমত মানুষের বিবেককে নিয়ে খেলতে থাকে।

অতঃপর প্রাক ইসলামী যুগে অর্থাৎ জাহিলিয়াতের যুগে তাদেরকে নির্বুদ্ধিতার বিভিন্ন মাযহাব ও ধর্মীয় কুসংস্কারে বিভক্ত করেছে। ফলে তারা বায়তুল হারামে পর্যন্ত মূর্তিপূজা করতে শুরু করেছিল। তারা কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত। কন্যা এবং অনুরূপ দুর্বল ওয়ারিসদেরকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করত। এমনিভাবে আরো বহু ভ্রষ্টতা ও কুসংস্কার ইবলিস তাদের নজরে সুশােভিত করে তুলে। তাই শয়তানের ফাঁদ থেকে সর্তক থাকা জরুরি। নামাজের ও অযুর ব্যাপারে শয়তানের ধোঁকা থেকে বাচা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা নামাজ আল্লাহর হক।

অযুর ক্ষেত্রে শয়তানের ধোঁকাঃ

কিছু মানুষ অযুর সময় বিভিন্ন ধরনের নিয়ত মুখে উচ্চারণ করে এবং বার বার উচ্চারণ করে। যেমন বলে, আমি নাপাক দূর করার জন্য অযু করছি। নামায বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য অযু করছি, আর এটা বার বার বলে। অথচ নিয়ত হচ্ছে অন্তরের ইচ্ছার নাম। মুখে যদি কেউ উচ্চারণ করতে চায় তবে একবার উচ্চারণ করলেই যথেষ্ট, বার বার উচ্চারণ করার কোন প্রয়োজন নেই।

আবার কখনও অযুর পানির ব্যাপারে শয়তান ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি করে যে, যে পানি দিয়ে অযু করছ সেটা কোথা হতে আনা হয়েছে ? পাক জায়গা হতে নাকি নাপাক জায়গা হতে, পানি আবৃত ছিল নাকি অনাবৃত ছিল; অনাবৃত থাকলে পাখি হয়তো তাতে পায়খানা করে রেখেছে। এ ধরনের বিভিন্ন সন্দেহের সৃষ্টি করে। কিছু লােক অযু গােসলে অধিক পানি খরচ করে। এতে চারটি অসুবিধা ও মাকরূহ বিষয় রয়েছে।

যথা-

১. পানির অপচয়

২. সময়ের অপচয়

৩. শরীয়তের নির্দেশকে উপেক্ষা করা। কেননা শরীয়তের নির্দেশ হচ্ছে অল্প পানি খরচ করা।

৪. শরীয়ত তিনবারের অধিক ধৌত করাকে জুলুম বা সীমা লঙ্ঘন বলে আখ্যায়িত করেছে। অধিক পানি খরচ করে নিজের উপর জুলুম করা হচ্ছে এবং সীমা লঙ্ঘন করা হচ্ছে।

কেউ কেউ অযুতে এত সময় কাটায় যে, নামাযের ওয়াক্ত চলে যায় অথবা প্রথম ওয়াক্তের ফজিলত থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। শয়তান এসে ওয়াসওয়াসা দেয় যে, অযুতে সাবধানতা অবলম্বন করা চাই। কারণ অযু শুদ্ধ না হলে নামাযই শুদ্ধ হবে না। কিন্তু মানুষ বুঝতে পারছে না যে, এটা মূলতঃ সাবধানতা নয় বরং শয়তানের ধোকা ও ওয়াসওয়াসা। কারণ যদি সাবধান হত তবে সে হারাম খাবার, গীবত ইত্যাদি বিষয় থেকেও সাবধানতা অবলম্বন করত।

অথচ দেখা যায় যে, সে এসব নাজায়েয বিষয়ে লিপ্ত রয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) বর্ণনা করেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দ (রাঃ) -এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সাদ (রাঃ) তখন অযু করছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ওহে সাদ ! এটা কেমন অপচয়?”

সাদ (রাঃ) বললেন, “রাসূলুল্লাহ ! অযুর কাজে পানি ব্যবহার করলেও কি অপচয় গণ্য হবে?”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ, যদিও তুমি প্রবাহমান নদীর তীরে বসে অযু কর। হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, অযুতে ওয়াসওয়াসা দেয়ার জন্য ওয়ালাহান নামের একটি শয়তান নিযুক্ত রয়েছে। অতএব তােমরা পানির ব্যাপারে তার ওয়াসওয়াসা থেকে বেঁচে থাক।

আবু নােয়ামা বর্ণনা করেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল (রাঃ) একদা আপন পুত্রকে দুআ করতে শুনলেন যে, “হে আল্লাহ ! আমি যখন জান্নাতে প্রবেশ করব তখন আমাকে জান্নাতের ডান দিক থেকে সাদা প্রাসাদটি দান করবেন।” আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল (রাঃ) এটা শুনে বললেন, “বৎস! তুমি আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা কর এবং জাহান্নাম থেকে পানাহ চাও। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, এ উম্মতে এমন এক সম্প্রদায় আসবে যারা দু এবং অযুতে সীমা লঙ্ঘন করবে।”

জনৈক আরব বেদুঈন মসজিদে প্রস্রাব করে দিলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে এক বালতি পানি ঢেলে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। জনৈকা মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমার কাপড়ের আঁচল দীর্ঘ। আমি তো ঐ জায়গা (নাপাক) জায়গা দিয়ে গমন করি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, “ঐ নাপাক জায়গার পরে পাক জায়গা আছে কি? ঐ পাক জায়গা একে পাক করে দিবে।” (অর্থাৎ শুষ্ক নাপাক, পাক মাটিতে লেগে দূরীভূত হয়ে যাবে)।

আসওয়াদ ইবনে সালেম বিশিষ্ট আউলিয়া কেরামের মধ্যে একজন ছিলেন। তিনি প্রথমে অযুতে অধিক পানি খরচ করতেন। কিন্তু পরে অনেক কম পানি খরচ করতে শুরু করেন। এক ব্যক্তি তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তরে বললেন, এক রাত্রে আমি ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ এক আওয়াজ কানে এল, “হে আসওয়াদ ! এটা কেমন অপচয়?” এরপর থেকে আমি অধিক পানি খরচ করা ছেড়ে দিয়েছি।

নামাযের ক্ষেত্রে শয়তানের ধোঁকাঃ

নামাজের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনে কিছু লােক পরনের কাপড় থাকা সত্ত্বেও বার বার ধৌত করে, কেউ কাপড়ে হাত লাগালে ধুয়ে ফেলে। কেউ কাপড় ধৌত করার জন্য দজলা নদীতে চলে যেত যেন পুকুর বা কূপের পানি যথেষ্ট নয়। সাহাবায়ে কেরামের অবস্থা এই ছিল যে, পারস্য জয় করেছেন সেখান থেকে পােশাক আসত সেগুলাে ধৌত করা ছাড়াই পরিধান করে নামাজ পড়তেন। কিছু লোক কাপড়ের কোন এক স্থানে একটু ছিটা নাপাক লাগলে সমস্ত কাপড় ধৌত করে ফেলে।

এরূপ করতে গিয়ে অনেক সময় জামাতই ছেড়ে দেয়। কিছু লােক হালকা একটু বৃষ্টি হলেই ময়লা পানির ছিটা আসবে এ আশংকায় জামাত ছেড়ে দেয়। কাউকে শয়তান এভাবে ওয়াসওয়াসা দেয় যে, নামাজ শুরু করার সময় বার বার মুখে উচ্চারণ করতে থাকে আমি অমুক নামায আদায় করছি। সে মনে করে আমার পূর্বের নিয়ত বিনষ্ট হয়ে গেছে। অথচ নিয়ত তাে হচ্ছে অন্তরের বিষয়। অন্তরের ধ্যান ঠিক থাকলে মুখে কিছু উল্টা পাল্টা হলেও কোন অসুবিধা নেই।

আবু হাযেম (রহঃ) একদা নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে মসজিদে প্রবেশ করলেন। তখন শয়তান এসে ওয়াসওয়াসা দিল যে, তুমি কি অযু ছাড়াই নামাজ পড়ার ইচ্ছা করেছ ? আবু হাযেম (রহঃ) বললেন, “আরে দুশমন ! তোর উপদেশ আমার ব্যাপারে কার্যকর হবে না।” ইবনে আকীল ( রহঃ ) সম্পর্কে এক বিস্ময়কর ঘটনা বর্ণিত রয়েছে। একদা তার নিকট জনৈক ব্যক্তি এসে বলল, “হুজুর আমি অযুর জন্য এক অঙ্গ ধৌত করি কিন্তু পরে মনে হয় ধৌত করিনি। এমনিভাবে নামাযের তাকবীর বলি কিন্তু মনে হয় তাকবীর বলিনি।”

ইবনে আকীল (রহঃ) বললেন, “তুমি নামাজই ছেড়ে দাও। তােমার উপর নামায ওয়াজিব নয়।” উপস্থিত লােকেরা জিজ্ঞেস করল, “হুজুর ! এটা কেমন ফতােয়া দিলেন।” ইবনে আকীল (রহঃ) বললেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “পাগল যতক্ষণ সুস্থ না হয় এবং তার জ্ঞান ফিরে না আসে ততক্ষণ তার উপর শরীয়তের কোন হুকুম বা নির্দেশ বর্তাবে না।” অতএব যে ব্যক্তি অযু করেও বলছে অযু করিনি এবং তাকবীর বলেও বলছে তাকবীর বলিনি, সে পাগল বৈ আর কি ? এরূপ ব্যক্তির জন্য উচিৎ শয়তান যখন এসে ওয়াসওয়াসা দেয় তখন শয়তানকে এ কথা বলে দেয়া যে, আমি অযু করেছি, তাকবীর বলেছি।”

কিছু লােক শয়তানের ওয়াসওয়াসায় বহু সুন্নত ছেড়ে দিয়েছে। কেউ নামাজে প্রথম কাতারে দাঁড়ানাে ছেড়ে দিয়েছে। তাদের যুক্তি হল, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে মন ও অন্তরের দিক থেকে কাছে থাকা আর সেটা আমার রয়েছে। কেউ নামাজে হাত বাঁধা ছেড়ে দিয়েছে। তার যুক্তি হল, এ অবস্থা অত্যন্ত বিনয়ের অবস্থা। আমার লজ্জা আসে যে, আমার অন্তরে যে বিনয় নেই সেটা কিভাবে প্রকাশ করব ? এগুলাে শয়তানের ওয়াসওয়াসা।

বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “মানুষ যদি জানত আযান দেয়া এবং নামাজের প্রথম কাতারে দাঁড়ানোতে কি ফযিলত ও সওয়াব রয়েছে তাহলে তারা ঐ ফজিলত লাভ করার জন্য লটারী ছাড়া অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করত না।” হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) আরো বর্ণনা করেন, পুরুষের জন্য সর্বোত্তম কাতার হলো সর্ব প্রথম কাতার আর সর্ব নিকৃষ্ট কাতার সর্বশেষ কাতার। আর মহিলার জন্য সর্বোত্তম কাতার হলো সর্বশেষ কাতার আর সর্ব নিকৃষ্ট কাতার হল সর্ব প্রথম কাতার।( মুসলিম )

হাত বাঁধা সম্পর্কে আবু দাউদ শরীফে ইবনে যুবাইর হতে বর্ণিত রয়েছে, হাত বাঁধা সুন্নত। ইবনে মাসউদ (রাঃ) নামাজে ডান হাতের উপর বাম হাত বাঁধতেন তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত খুলে ডান হাত বাম হাতের উপর রেখেছেন। কেউ কেউ হরফ উচ্চারণে অতিরঞ্জিত করে ফেলে। যেমন আলহামদু লিল্লাহ বার বার উচ্চারণ করতে থাকে যার ফলে নামাজের আদব ঠিক থাকে না। শয়তান এর পিছনে লেগে থাকে তেলাওয়াতের সময় আয়াতের মর্মের প্রতি ধ্যান করার ফজিলত থেকে বঞ্চিত রাখে।

সাহল ইবনে আবি উমামা বর্ণনা করেন, “আমি আমার পিতার সাথে হযরত আনাস (রাঃ) -এর খেদমতে গেলাম। তখন তিনি সংক্ষিপ্ত নামাজ আদায় করছিলেন, মনে হচ্ছিল যেন মুসাফিরের নামাজ। নামাজ থেকে অবসর হওয়ার পর আমার পিতা বললেন, “আল্লাহ তায়ালা আপনার প্রতি রহম করুন, এটা কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম – এর নামায? আপনি এটা ফরজ পড়েছেন নাকি নকল?”

হযরত আনাস (রাঃ) বললেন, “এটাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম – এর নামাজ। আমি এতে কোন প্রকার ত্রুটি করিনি তবে কিছু বিষয় ভুলে গিয়েছি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তােমরা নিজেদের উপর কঠোরতা করাে না, তাহলে আল্লাহ তােমার কঠোরতা করবেন না। এক সম্প্রদায় নিজেদের উপর কঠোরতা করেছিল আল্লাহও তাদের উপর কঠোরতা করেছেন। তাদের অবশিষ্টাংশ খ্রিষ্টানদের গীর্জায় ও ইহুদীদের উপাসনালয়ে বিদ্যমান রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তারা রাহবানিয়্যাত (সংসার ও ভোগ বিলাস ত্যাগ) প্রথা বের করেছে। আমি সেটা তাদের উপর ফরজ করিনি।

উসমান ইবনে আবিল আস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম – এর খেদমতে আরজ করলাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ ! শয়তান আমার নামাজ, কেরাত এবং আমার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এটা এক শয়তান; এর নাম খিনযার। এরূপ অনুভব হলে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইবে এবং বাম দিকে থুথু দিবে। আমি এরূপ করলে আল্লাহ তায়ালা এ অবস্থা দূরীভূত করে দিয়েছেন।”

কিছু লোক খুব লম্বা কেরাত পড়ে। অপর দিকে নামাজের ওয়াজিব বিষয়কে ছেড়ে দেয়। দিনে উচ্চস্বরে কিরাত পাঠ করা মাকরূহ। হযরত বুরহিদা (রাঃ) হতে বর্ণিত, কেউ যদি দিনে উচ্চস্বরে কেরাত পাঠ করে তবে তার গায়ে উষ্ট্র – বাহ্য ( পায়খানা ) নিক্ষেপ কর। কিছু লােক দীর্ঘ রাত জেগে নফল ইবাদত করে। রাত্রে জেগে নফল পড়ে এবং ইশরাকের নামাজ পড়ে, এতে ফরয আদায়ের চেয়ে বেশি আনন্দিত হয়। অনেক সময় অনেক রাত জাগ্রত থাকার কারণে ফজরের নামাজ ছুটে যায়। আবার কখনো জামাত ছুটে যায়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের উপর আপন দেহেরও একটি হক রয়েছে। অতএব নামাজের সময় নামাজ পড় এবং ঘুমানোর সময় ঘুমাও। তোমরা মধ্যম পন্থা অবলম্বন কর। কেউ যদি দ্বীনের ব্যাপারে কঠোরতা করে তবে সে দ্বীনের কাছে হেরে যাবে। হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা মসজিদে প্রবেশ করে দেখলেন, একটি রশি ঝুলানো। এবং জিজ্ঞেস করলেন, “এটি কার?” উত্তরে জানা গেল রশিটি জয়নবের (নবীজির স্ত্রী); যখন তিনি নামাজ পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে যান এবং ঘুম এসে যায় তখন এ রশিটি ধরে দাঁড়ান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “রশিটি খুলে ফেল।”

এরপর বললেন, যতক্ষণ তোমাদের মাঝে স্ফুর্তি থাকে ততক্ষণ নামাজ পড় আর যখন ক্লান্তি ও অলসতা এসে যায় তখন নামাজ থেকে বিরত থাক। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কারো যদি তন্দ্রা আসে তবে ঘুমিয়ে পড়বে যাতে ঘুম চলে যায়। কেননা, তন্দ্রাবস্থায় নামাজ পড়লে হয়তো সে ইস্তেগফারের ইচ্ছা করবে কিন্তু মুখে বলে ফেলবে এমন কথা যা তার জন্য ক্ষতিকর। এ হাদিস বুখারী মুসলিম উভয় কিতাবে রয়েছে।

উপরোক্ত বিষয়টি যেমনিভাবে হাদিসের দৃষ্টিতে অসমীচীন, তেমনিভাবে সাধারণ যুক্তির নিরিখেও অসমীচীন। কারণ ঘুমানোর ফলে শরীরে শক্তি ও স্মৃতি ফিরে আসে। ক্লান্তি আসার পর না ঘুমালে দেহ ও মস্তিষ্ক উভয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেউ বলতে পারে, পূর্বের বুজুর্গদের সম্বন্ধে শোনা যায় তারা সারারাত জেগেই ইবাদত করতেন। এর উত্তরে বলা হবে, তারা ধীরে ধীরে এ অভ্যাস করে নিয়েছেন। অধিকন্তু দিনের বেলায় কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে ক্লান্তি দূর করে নিতেন। তা ছাড়া তারা কম খেতেন। তারা সারা রাত জাগ্রত থাকলেও ফজরের নামাজ ব্যাহত হতো না। উপরন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্বন্ধে এমন কোন হাদিস আমাদের কাছে পৌছেনি যে, তিনি সারারাত জেগে ইবাদত করেছেন। আমাদের উচিত তারই সুন্নত এবং তরিকা অবলম্বন করা।

মুসলিমদের প্রতি শয়তানের আরেকটি প্ররোচনা হল, তাদের কিছু রাত জেগে নামাজ পড়ে আর দিনে তা মানুষের কাছে বর্ণনা করে। যেমন কেউ বলে, আজ ফজরের আজানের সময় মুয়াজ্জিন ঠিক সময়ে আল্লাহু আকবার বলেছেন। এর উদ্দেশ্য হল মানুষ যাতে বুঝতে পারে যে, সে রাত জেগে ইবাদত করেছে (ফজরের আগেই সে জেগেছে)। উল্লেখিত ব্যক্তির যদি রিয়া করার উদ্দেশ্য নাও থাকে তবুও সে গােপনীয়তা রক্ষাকারীদের দল থেকে বের হয়ে তাদের দলভুক্ত হয়ে গেল যারা স্বীয় আমল প্রকাশ করে (নিঃসন্দেহে ইবাদত বন্দেগীতে গােপনীয়তা রক্ষাকারীদের মর্যাদা অধিক)।

কিছু মুসলিম তাহাজ্জুদের নামাজের জন্য ভিন্ন ইবাদতখানা তৈরি করে আর তারা সেই ইবাদতখানার নামে প্রসিদ্ধ হয়ে যায়। তাদের সাথে আরাে মানুষ এসে উক্ত নামাজে শরীক হয় এবং তাদের খ্যাতি ছড়ায়। শয়তান ওয়াসওয়াসা ও ধোঁকা দিয়ে এরকম করায় ও এতে নফস খুশী হয়। কারণ এতে তার খ্যাতি ও প্রসিদ্ধি লাভ হবে। হযরত যায়েদ ইবনে ছাবেত (রাঃ) হতে এক হাদিস বর্ণিত আছে, ফরজ ব্যতীত অন্য নামাজ ঘরে আদায় করা উত্তম। আমের ইবনে কাইস নামাজ অবস্থায় তাকে অন্য কেউ দেখুক এটা অপছন্দ করতেন। তিনি মসজিদে নফল নামাজ পড়তেন না।

মুসলিমদের মাঝে কিছু এমন রয়েছে যারা মজলিসে কেঁদে উঠে। এটা যদিও কখনো হৃদয়ের নম্রতার কারণে হয়। তবে যদি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণ না করে তবে সে যেন নিজেকে রিয়াকারীদের মাঝে শামিল করল। আসেম (রহঃ) বর্ণনা করেন, আবু ওয়ায়েল যখন ঘরে নামাজ পড়তেন তখন তাঁর ক্রন্দনের আওয়াজ শোনা যেত। কিন্তু মানুষের সামনে ক্রন্দনের কথা বললে কখনো কাঁদতেন না।

আইয়ুব সাখতিয়ানী (রহঃ) -এর এ অবস্থা ছিল যে কোন মজলিসে যদি তার ক্রন্দন আসত তাহলে তিনি মজলিস থেকে উঠে চলে যেতেন। কিছু লোক ৫ দিনরাত নফল ইবাদত করে কিন্তু হালাল হারামের কোন চিন্তা করে না। অথচ তার জন্য নফল ইবাদতের পরিমাণ বৃদ্ধি করার চেয়ে হালাল হারাম জানা এবং অভ্যন্তরীণ চরিত্র সংশোধনের প্রতি লক্ষ্য করা বেশি প্রয়োজন ছিল। কারণ হারাম খাবার খেলে পরবর্তী চল্লিশ দিনের ইবাদত আল্লাহর কাছে কবুল হয়না।

রাসূলু্ল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমস্ত কুপ্রথা ও কুসংস্কার নির্মূল করেন এবং সত্য ও কল্যাণের পথ অর্থাৎ শরীয়ত প্রবর্তন করেন। তাঁর সাহাবীরা তাঁর জীবদ্দশায় এবং তাঁর তিরােধানের পরও ঐ উজ্জ্বল পথের আলােকে শয়তানের ধোকা থেকে বেঁচে রীতিমত পথ চলতে থাকেন। কিন্তু যখন তাদের নূরানী চেহারা যা থেকে আলাে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল তা বিলীন হয়ে গেল তখন আবার অন্ধকার সামনে এসে গেল; প্রবৃত্তিপূজা পূনরায় বেদআতের ভিত্তি স্থাপন করতে শুরু করে, সুপ্রশস্ত শরীয়তের পথে ত্রুটি ও শিথিলতার জাল বিস্তার করতে শুরু করে।

বহু লােক সত্য দ্বীন থেকে বিচ্যুত হয়ে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। অথচ তারা ইতিপূর্বে একই দলভুক্ত ছিল। ইবলিস তাদেরকে তার চক্রান্ত জালে আবদ্ধ করতে এবং তাদের মাঝে অনৈক্য সৃষ্টি করতে শুরু করে। তবে জেনে রাখতে হবে যে, ইবলিস তার চক্রান্তকে ঐ সময়ই কার্যকর করতে সক্ষম হবে, যখন মূর্খতা ও অজ্ঞতার আধারাচ্ছন্ন রজনী থাকে। কিন্তু যখন ইলম ও জ্ঞানের আলাে মাখা ভাের এসে যায় তখন তার চক্রান্ত আর চলে না, তখন সে লজ্জিত ও লাঞ্ছিত হয়ে যায়। তাই ইবলিসের চক্রান্ত সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিত কারণ গােনাহর কারনগুলো জানলেই কেবল গােনাহে পতিত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

রেফারেন্সঃ

ইমাম হাফেজ জামাল উদ্দিন আব্দুল ফরজ আব্দুর রহমান ইবনুল জাওযী (রহঃ), মাওলানা মতিউর রহমান,(২০০২)। শয়তানের ধোঁকা। চকবাজার,ঢাকা; মোহাম্মদী লাইব্রেরী।

Share this post on..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *