
১২০৩ সাল থেকে সাড়ে পাঁচশত বছর পর্যন্ত মুসলমানরা বাংলার শাসন পরিচালনা করে। অবশেষে ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে পরাজিত হন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলাহ্। বাংলার স্বাধীনতা কেড়ে নিল ইংরেজরা। স্বাভাবিকভাবেই বাংলার হিন্দুরা ইংরেজদের স্বাগত জানায়। আর মুসলমানরা হয়ে উঠে বিদ্রোহী।
ইংরেজ রোষানলে ক্রমান্বয়ে মুসলমানগণ হয়ে উঠে নিঃস্ব এবং অবহেলিত। অন্যদিকে হিন্দুরা ইংরেজদের সহযোগী হিসেবে ক্রমেই হয়ে উঠে স্বাবলম্বী ও সুবিধাভোগী। ইংরেজ এবং হিন্দু জমিদাররা মিলে মুসলমানদের উপর চালাতে থাকে অত্যাচারের স্টিমরোলার।
শুরু হলো ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন। নেতৃত্বে মুসলমান। স্বাধীনতা হারানোর মাত্র কয়েক বছর পর মীর কাসিম বাংলার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। মীর কাসিম বক্সারের যুদ্ধে হলেন পরাজিত।
কিন্তু বিদ্রোহ থেমে থাকে না। মজনু শাহের নেতৃত্বে গড়ে উঠে ফকির বিদ্রোহ। ফকির বিদ্রোহ একটু ঝিমিয়ে পড়তেই গর্জে উঠলেন আর এক সাহসী সৈনিক সৈয়দ আহমদ শহীদ। তাঁর আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল খোলাফায়ে রাশেদীনের মতো ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করা। সারা ভারতব্যাপী এ আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। অবশেষে ১৮৩১ সালে সম্মুখ সমরে শহীদ হন সৈয়দ আহমদ ও তাঁর অনেক অনুসারী। বালাকোটের শহীদদের মধ্যে কমপক্ষে নয় জন এবং আহতদের মধ্যে চল্লিশজন ছিল বাংলাদেশী।
১৮৩১ সালে বাংলা প্রদেশে আর এক বীর স্বাধীনতাকামী শহীদ হলেন সম্মুখ সমরে। তিনি হলেন শহীদ তিতুমীর। তার পূর্ণনাম সাইয়েদ নিসার আলী তিতুমীর। তিনি শহীদ সৈয়দ আহমদের চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত ছিলেন।
এই আন্দোলনেরই ধারাবাহিকতায় যুক্ত হলেন আর এক সাহসী সংগ্রামী বীরপুরুষ। তিনি হলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ। ১৭৮১ সালে মাদারীপুর জেলার বাহাদুরপুরে তাঁর জন্ম। স্থানীয় জমিদার আবদুল হাজী তালুকদার তাঁর পিতা। শিশু অবস্থায় শরীয়তুল্লাহকে রেখে পিতা ইন্তেকাল করেন।
পিতার মৃত্যুর পর চাচা তাঁর লালন পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শিক্ষা লাভের জন্য বালক শরীয়তুল্লাহকে পাঠানো হলো কলকাতায়। কলকাতার মাওলানা বাশারত আলীর তত্ত্বাবধানে চলতে থাকে শরীয়তুল্লাহর বিদ্যার্জন। পরে তাঁকে হুগলী মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়।
মাঝে একবার নিজ গ্রামে ফেরার পথে দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে নৌকা ডুবিতে হারান চাচা-চাচীকে। মাতৃভূমিতে ফিরতে না পেরে আবার চলে যান মাওলানা বাশারত আলীর গৃহে। কিছুদিন পর ওস্তাদের সাথে চলে গেলেন পবিত্র মক্কা-মুর্কারমাতে।
মক্কার আলেমদের কাছে চলে তাঁর শিক্ষা অর্জন। বহু ভাষা আয়ত্ত করেন। হজ্জ করেন অনেকবার। মক্কাতে শেষ পর্যন্ত শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। প্রসিদ্ধি লাভ করেন এখানেও।
১৮১৮ সালে দীর্ঘ প্রবাস জীবনের সমাপ্তি টেনে ফিরে আসেন নিজ জন্মভূমিতে। মুসলমাদের অধঃপতন দেখে দুঃখে ভরে গেল তাঁর মন। কুসংস্কার, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অভাব, দারিদ্র্য আর শোষণ নির্যাতনে মুষড়ে পড়া মুসলমানদের দুরবস্থা তাঁকে দারুণভাবে ব্যথিত করে। ইংরেজ এবং হিন্দু জমিদাররা একতাবদ্ধ হয়ে মুসলমানদের দমিয়ে রাখছে। তারা মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও ধ্বংস করার চেষ্টা করতো সারাক্ষণ। তাদের হাতে ক্ষমতা ও অর্থ থাকার কারণে দরিদ্র মুসলমানদের প্রভাবিত করা সহজ ছিল।
শরীয়তুল্লাহ দেখলেন ইসলামের মৌলনীতি বিসর্জন দিয়ে মুসলমানরা শিরক ও বিদআতে লিপ্ত। শুরু করলেন দাওয়াতী তৎপরতা। বেগবান করলেন তাঁর সংস্কার আন্দোলন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় মুসলমানরা তাঁর আহ্বানে তেমন সাড়া দেয়নি। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে আবার ধরলেন মক্কার পথ। এবার চললেন সারা পথ পায়ে হেঁটে। পথে পথে সফর করলেন বিভিন্ন মুসলিম জনপথ। যিয়ারত করলেন প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের কবরসমূহ। দেখা করলেন জীবিত আলেম ওলামাদের সাথে। বাগদাদ, বাইতুল মুকাদ্দাস, মিসর সফর শেষে পৌঁছলেন পবিত্র মক্কা নগরীতে। মক্কার পূর্ব পরিচিতজনদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। পবিত্র হজ্জ করেন।
এ যাত্রায় তিনি মক্কাও মদিনায় দুই বছর কাটান। সাক্ষাৎ করেন বড় বড় ওলামাদের সাথে। এবারের মক্কা মদিনায় অবস্থানকালে তিনি রসুল (স.)-কে স্বপ্নে দেখেন। ১৮২০ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশের পরিবর্তিত অবস্থা দেখে উৎসাহিত হন। এ সময় মজলুম জনতা সংগ্রামমুখর হয়ে ওঠে হিন্দু জমিদার ও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে।
যাবতীয় কুসংস্কার পরিত্যাগ করে ইসলামের খাঁটি অনুসারী হওয়ার জন্য তিনি তাঁর সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। সাধারণ মুসলমানদের তিনি নৈতিকতায় উদ্বুদ্ধ করেন। দীর্ঘকাল মক্কায় অবস্থান করে হাজী শরীয়তুল্লাহ কেবল কোরআন, হাদীস, ফিকাহ, তাসাউফই শেখেননি। তিনি বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন পরিপূর্র্ণ ইসলাম, সমাজবিজ্ঞান ও রাজনীতি সম্পর্কে। তিনি দাওয়াতী কাজ শুরু করলেন জোরেশোরে। আপন-পর-সকল মানুষের মাঝে। দাওয়াতী আন্দোলন যত বেগবান হতে থাকল বিরোধিতাও শুরু হল তত তীব্র বেগে।
হাজী শরীয়তুল্লাহর এই সংগ্রাম ফরায়েজী আন্দোলন নামে অভিহিত হলো। ফরজ শব্দের বহু বচন ফরায়েজ। আর তা থেকেই ফরায়েজী। যারা আল্লাহ নির্ধারিত অবশ্য পালনীয় কর্তব্যসমূহ (ফরজ) পালনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তাদেরই ফরায়েজী বলা হয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি বিপুল সংখ্যক মুসলমানকে এই আন্দোলনের সদস্য করে তোলেন। হাজী শরীয়তুল্লাহ তাঁর আন্দোলনের সদস্য এবং সাধারণ মুসলমানদের ধর্মের সাথে কর্মের মিল রাখার জন্য কঠোর নির্দেশ দিতেন।
হাজী শরীয়তুল্লাহর আন্দোলন সম্পর্কে জেমস টেইলর বলেন, “কুরআনকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই ছিল ফরায়েজী আন্দোলনের উদ্দেশ্য।” একটি চমক দিয়েই ক্ষান্ত হওয়ার লোক ছিলেন না হাজী শরীয়তুল্লাহ। তিনি ধীরে ধীরে একটি স্থায়ী সাংগঠনিক কাঠামো গড়ার দিকে মনোনিবেশ করলেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক জেমস ওয়াইজের মতে, “শিরক ও বিদআত থেকে স্থানীয় মুসলমানদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে হাজী শরীয়তুল্লাহই পূর্ববঙ্গের ইসলামের প্রথম সংস্কারক ও প্রচারক।” এ থেকেই বোঝা যায় ইসলামের খেদমতে শরীয়তুল্লাহর অবদান কত বেশি।
তাঁর সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন চরিত্র, সাদামাটা জীবন, অমায়িক ব্যবহার, আন্তরিক চেষ্টা, সবাইকে সমাজ মর্যাদা দানের অঙ্গীকার- যে কাউকে মোহিত ও মুগ্ধ করার জন্য ছিল যথেষ্ট। এমন একজন অনুকরণ ও অনুসরণযোগ্য নেতাই তখনকার পরিবেশে প্রয়োজন ছিল বেশি। ফলে তিনি সহজেই একটি গতিশীল আন্দোলন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
হাজী শরীয়তুল্লাহ রাজনৈতিকভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হন। অন্যদিকে তিনি অত্যাচারী হিন্দু জমিদার ও নীল কুঠিয়ালদের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হন। সেই সাথে বেগবান রাখেন মুসলমানদের মধ্যে শিরক, বিদআত ও কুসংস্কার দূর করার জন্য সংস্কারের এক মহাবিপ্লবের ধারা। তিনি অবহেলিত ও বঞ্চিত মুসলিম জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলেন। সারা পূর্ববাংলা ও আসামে তাঁর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর এই সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিল সাধারণত সমাজের দরিদ্র কৃষক শ্রেণী। তিনি তাদের সংঘবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করলেন। ১৮৩৭ সালে হাজী শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্বে ছিল সাড়ে বার হাজার সক্রিয় কর্মী। বিশাল জনশক্তি তাকে সমর্থন ও সহযোগিতা করত।
হাজী শরীয়তুল্লাহর সমসাময়িক কালে বাংলায় আরও কিছু আন্দোলন চলছিল। তিনি অত্যন্ত সতর্কভাবে তাদের সাথে বিরোধ এড়িয়ে চলতেন। মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরীর আন্দোলন এবং আহলে হাদীস আন্দোলন এ সময় চালু ছিল। মাওলানা কেরামত আলী সমাজে প্রচলিত অনেক ব্যাপারে নমনীয় হয়ে কিছুটা ছাড় দেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। আহলে হাদীস আন্দোলনও ক্রমে রাজনৈতিক রূপ নেয়। কিন্তু কোনো নেতা অন্যের আন্দোলনকে অবজ্ঞা করেননি। লিপ্ত হননি সরাসরি কোনো বিরোধিতায়। হাজী শরীয়তুল্লাহ এ সময় অত্যন্ত কৌশলি কর্মপন্থা গ্রহণ করেন।
তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হন। তাঁর কর্মীদের পুলিশ ও জমিদার বাহিনী নানাভাবে অত্যাচার করেছিল। হাজী শরীয়তুল্লাহর কর্মক্ষেত্র ছিল ঢাকা জিলার নয়াবাড়ীতে। হিন্দু জমিদারদের চরম বিরোধিতার কারণে তাকে নয়াবাড়ী ছাড়তে হয়। চলে যান নিজ গ্রাম মাদারীপুরের শামাইলে। সেখান থেকে পূর্ণগতিতে চলতে থাকে সংস্কার আন্দোলন। এ সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচারও চলতে থাকে।
হাজী শরীয়তুল্লাহর ছিল উন্নত চরিত্র। ছিল অতুলনীয় মানবীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য। তিনি মানুষকে সহজেই মুগ্ধ করতে পারতেন। আদর্শ ও চরিত্রের গুণেই তিনিই জয় করেছিলেন ভাগ্যাহত মানুষের মন। প্রকৃত অর্থেই হাজী শরীয়তুল্লাহ ছিলেন একজন নির্ভীক ও নিবেদিতপ্রাণ সমাজ সংস্কারক। এদেশের মুসলমানদের চরম দুর্দিনে তিনি যোগ্য অভিভাবকের মতো তাদের কাছে টেনে নিয়েছিলেন। ইংরেজদের শত বাধা এবং হিন্দুদের হাজার চেষ্টাতেও এ উপমহাদেশের সংগ্রামরত বীর মুজাহিদদের আন্দোলন কখনো থেমে থাকেনি। তাদের রক্তচুকে উপেক্ষা করে সর্বদা এগিয়ে গেছেন সকল সাহসী মুজাহিদ। এই সাহসী মুজাহিদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ। আমৃত্যু তিনি লড়ে গেছেন একজন প্রকৃত সৈনিকের মতো। লড়ে গেছেন সত্যের পক্ষে এবং মিথ্যার বিপক্ষে।
হাজী শরীয়তুল্লাহ তাঁর সূচিত আন্দোলনের পূর্ণ সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। ১৮৪০ সালের ২৮ জানুয়ারি মাত্র ৫৯ বছর বয়সে এই মর্দে মুজাহিদ, কৃষকবন্ধু, স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রসাধক এবং দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টা ইন্তেকাল করেন। পরবর্তীকালে ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র মোহসীন উদ্দিন দুদুু মিয়া। সিপাহী বিদ্রোহ পর্যন্ত এ আন্দোলন প্রবলভাবে অব্যাহত থাকে। আজও ক্ষীণভাবে হলেও এ আন্দোলনের ধারা চালু আছে।
হাজী শরীয়তুল্লাহ এবং তাঁর সংগ্রামী জীবন যে কত বিশাল-ব্যাপক ছিল তার তুলনা তিনি নিজেই। সারা জীবন তিনি মানুষের মুক্তির সংগ্রাম করে গেছেন। আমাদের সংগ্রামে, আমাদের জাগরণে, আমাদের অনুভবে এবং আমাদের চলার পথে তিনি আছেন সাহসের মশাল হাতে নিয়ে। আমাদের সকল সংগ্রাম ও আন্দোলনের প্রেরণার উৎস হিসেবে জেগে আছেন হাজী শরীয়তুল্লাহ। তাঁর আদর্শ ও আন্দোলন আজ আমাদের পথহারা জাতিকে পথ দেখাতে পারে। ইসলাম যে যেকোন ধরনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং শোষিত জনগণের পাশে থাকে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তই রেখে গেছেন হাজী শরীয়তুল্লাহ।
হাজী শরীয়তুল্লাহর নামে আজ শরীয়তপুর জেলার নামকরণ হয়েছে। আসলে তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হওয়া উচিত। মানুষের সামনে তাঁর আদর্শ বিকশিত হওয়ার দরকার। যাতে দিশেহারা জাতি তাঁরই অনুপ্রেরণায় ইসলামের আলোকে আলোকিত হতে পারে।
লেখক : ডাঃ সুলতান আহমেদ
(সাপ্তাহিক সোনার বাংলা থেকে)
ছবিঃ ১০ মার্চ ১৯৯৩ সালে তার নামে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ডাকটিকিট বের করে।