ইসলামের আলোকে জিন জাতির ইতিহাস (পর্ব ৩)

আতিয়া ফাইরুজ; ১৯ জুলাই ২০২১

জিনদের মধ্য থেকে কোন নবী রাসূল ছিল কি?

অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতামত হল জিনদের মধ্য থেকে কোন নবী রাসূল হয়নি। ইবনে আব্বাস মুজাহিদ এবং হযরত কালবী প্রমুখ মনীষী এ মতের প্রবক্তা। আল্লাহর বাণী- হে জিন ও মানুষেরা তোমাদের নিকট কি তোমাদের মধ্য থেকে রাসূল আগমন করেনি? (-সূরা আনআম : ১৩০)। এই উল্লেখিত আয়াতের তাফসীরে মুজাহিদ বলেন জিনদের মধ্য থেকে কোন রাসূল হয়নি।

নবী করিম (সাঃ) জিন ও মানুষের নবী

নবী করিম (সাঃ) জিন ও ইনসানের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। এ ধ্রুব সত্য কথাটির কোন মুসলমানই মতপার্থক্য করে না। এ ব্যাপারে বুখারী ও মুসলিম শরীফে রয়েছে যে, নবী করিম (সাঃ) এরশাদ ফরমান যে, “আমাকে জিন ও ইনসানের জন্য নবী করে প্রেরণ করা হয়েছে।”

ইবলিসের যুবক ও বৃদ্ধ হওয়া

ইবনে আব্বাস বলেন এক যুগ অতিবাহিত হলে ইবলিস বৃদ্ধ হয়ে যায় তারপর আবার ত্রিশ বছরের যুবকে সে ফিরে আসে। (-গারাইবুসসুনান, ইবনে শাহীন)

জান্নাতে মানুষ জিনদের দেখতে পাবে কিন্তু জিনেরা কোনো মানুষ দেখতে পারবে না

আল্লামা মাহাসাবী (রা.) বলেন যে জান্নাতে জিনদেরকে মানুষেরা দেখতে পাবে কিন্তু জিনেরা কোন জান্নাতী মানুষকে দেখতে পারবে না। সেখানে দুনিয়ার বিপরীত কাজ হবে।

জিনের রূহ কবজকারী ফেরেশতা কে?

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মালাকুল মউত (আজরাইল) মানুষ এবং ফেরেশতার প্রাণ কবজ করার দায়িত্বে আছেন এবং জিনদের প্রাণ কবজ করার জন্য আলাদা ফেরেশতা আছে। পাখ-পাখালী, হিংস্র প্রাণী, মৎস্য, পিপীলিকা ইত্যাদির জন্য আলাদা ফেরেশতা রয়েছে। এ কাজে নিয়োজিত চারজন ফেরেশতা। (তাফসীরে জুযাইবার)

প্রত্যেক মানুষের সাথে অবস্থানকারী শয়তান

হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত- একরাতে হুজুর (সাঃ) বাইরে কোথাও তাশরীফ নিলেন। হযরত আয়েশা বলেন, আমার ধারণা তিনি হয়ত তার অন্য কোন বিবির সকাশে গমন করেছেন। হুজুর (সাঃ) ফিরে এসে আমাকে দেখেই বললেন তােমাকে তোমার শয়তান প্ররােচনায় ফেলেছে। আমি বললাম “হে আল্লাহর নবী! আমার সাথে কি শয়তান আছে?”- হুজুর (সাঃ) বললেন,

শয়তান তাে সকল মানুষের সাথেই আছে

আমি বললাম হে আল্লাহর নবী তাহলে কি আপনার সাথেও আছে ? হুজুর (সাঃ) বললেন, “হ্যাঁ, তবে আমার প্রভু আমার সহায়ক।” (-মুসলিম; হা.নং- ৮৮)

হুজুর (সাঃ)- এর সাথে রক্ষিত শয়তান মুসলমান হয়ে গেছে

হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন জনাব নবী করিম (সাঃ) এরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে এমন কোন লােক নেই যার সাথে তার সঙ্গী একজন জিন ও একজন ফেরেশতা। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর নবী! তাহলে কি আপনার সাথেও আছে? হুজুর (সাঃ) বললেন, “হ্যাঁ, আমার সাথেও আছে তবে তার মোকাবেলায় আল্লাহ পাক আমাকে সহায়তা করেন। সে মুসলমান হয়ে গেছে, এখন সে আমাকে কল্যাণ ছাড়া অন্য কোন কথা বলে না।” (-মুসলিম- হাঃ নং -৬৯)

মানুষকে জিনে ধরে কেন ?

আল্লামা আবু তাইমিয়া বলেন, মানুষকে জিনে আক্রমণ করার কারণ হল জৈবিক চাহিদা মেটানো, ভালবাসা ও প্রেমের টান। আবার কখনো কখনো বৈরীতা বশত এবং প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। যেমন- জিনদের উপর পেশাব করার কারণে বা পানি ফেলার কারণে কিংবা তাদের কাউকে হত্যা করার কারণে, যদিও তাদের হত্যা মানুষ অবগত নয়। আবার কোন কোন সময় কেবল কষ্ট দেয়া ও খেলার জন্য হয়ে থাকে যেমন নির্বোধ লোকেরা এরকম করে।

হাই তােলা শয়তানের কাজ

হযরত আবু হােরায়রা (রা.) বলেন, নবী করিম (সাঃ) এরশাদ করেন, আল্লাহ পাক হাঁচি পছন্দ করেন এবং হাই অপছন্দ করেন। তোমাদের কেউ হাঁচি দেওয়ার পর আলহামদুলিল্লাহ পড়লে যারা তা শ্রবণ করবে তাদের উচিত “ইয়ারহামুকাল্লাহ” বলা। আর হাই শয়তানের পক্ষ থেকে হয়। তােমাদের কোন লােকের হাই এলে তা প্রতিহত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে, কারণ তােমাদের কেউ মুখ খুলে হাঁ বললে এতে শয়তান খুব খুশি হয় এবং হাইদাতার পেটে শয়তান হাসে।

হযরত আবু হােরায়রা (রা.) বলেন, নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ ফরমান, হাঁচি আসে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আর হাই শয়তানের পক্ষ থেকে। তােমাদের কারাে হাই এলে হাত দ্বারা মুখ চেপে ধরবে কেননা হাই তােলার সময় মানুষ আহ আহ করলে শয়তান তার পেটে প্রবেশ করে হাসতে থাকে। আল্লাহ তা’য়ালা হাঁচি ভালোবাসেন এবং হাইতোলা অপছন্দ করেন। –তিরমিযি

হত্যার পন্থা শয়তান শিখিয়েছে

ইবনে জুরাইহ বলেন হযরত আদম (আ.)- এর পুত্র তার অপর ভাইকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল বটে, কিন্তু কিভাবে হত্যা করবে তা তার জানা ছিল। এ সময় শয়তান একটি পাখির বেশ ধারণ করে তার সম্মুখে এসে আরেকটি পাখিকে ধরে তার মাথা দুটি পাথরের মাঝখানে রেখে চাপ দেয় তা দেখে সেও উক্ত পন্থা অবলম্বন করে তার ভাইকে হত্যা করে ফেলে।

নামাজের মধ্যে শয়তানের শয়তানী

হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, নামাযীর নামাজ নষ্ট করার জন্য শয়তান চারপাশে ঘুরতে থাকে। নামাজ বিনষ্ট করতে সে যখন নিরাশ হয়ে যায় তখন নামাজীর মলদ্বারে ফুক দেয়। যাতে নামাযী মনে করে আমার ওযু চলে গেছে। বর্ণনাকারী বলেন, তোমাদের কারো এরকম হলে নামাজ ছেড়ে দিবে না যতক্ষণ না কোনো দুর্গন্ধ বা আওয়াজ না পাও।

নামাজে তন্দ্রা আসে শয়তানের পক্ষ থেকে

হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, যুদ্ধের ময়দানে তন্দ্রা আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে (ইহা আল্লাহর সাহায্য) আর নামাযের মধ্যে তা আসে শয়তানের পক্ষ থেকে -তিবরানী। নামাজের ভিতরে হাই ও হাঁচি শয়তানের পক্ষ থেকে হয়। -ইবনে আবু শায়বাহ

তাড়াহুড়ো করা শয়তানের কাজ

নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ ফরমান- কোন কাজের জন্য অপেক্ষা করা আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং তাড়াতাড়ি করা শয়তানের পক্ষ থেকে।

গাধা শয়তানকে দেখে থাকে

হযরত আবু হােরায়রা (রা.) বলেন, নবী করিম (সাঃ) এরশাদ করেন- “তোমরা মোরগের আওয়াজ শুনলে আল্লাহর নিকট কল্যাণ কামনা কর, কেননা সে ফেরেশতা দেখেই ডাক দেয় আর গাধার চিৎকার শুনলে শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাও। কারণ গাধা শয়তানকে দেখে চিৎকার করে “। -বুখারী, মুসলিম

নামাজের কাতারে শয়তানের প্রবেশ করা

হযরত আনাস (রা.) বলেন, নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেন- তোমরা নামাযের কাতারে পাশাপাশি হয়ে দাঁড়াও। গর্দান সোজা রেখে মিলেমিশে দাঁড়াও। আমি সেই সত্তার শপথ করে বলছি যার হাতে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রাণ, আমি শয়তানকে দেখতে পাই। সে হাঁসের বেশ ধরে কাতারের ফাক দিয়ে প্রবেশ করে।” (-মুসনাদে আহমদ : ২৬০/৩)

শয়তান যে সমস্ত আকৃতি ধরতে পারে না

হযরত আবু কাতাদা (রা.) বলেন, নবী করিম (সাঃ) এরশাদ ফরমান- যে ব্যক্তি স্বপ্নে আমাকে দেখেছে সে সত্যি আমাকে দেখেছে। কেননা শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না। (-বুখারী , মুসলিম) শয়তান কাবা ঘরের আকৃতি ধারণ করতে পারে না (-তিবরানী)। শয়তান হযরত আবু বকর (রা.)- এর আকৃতিও ধারণ করতে পারে না। ( তারিখে বাগদাদ )

শয়তান থেকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা

হযরত জাবির (রা.) বলেন নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ ফরমান- রাত আরম্ভ হলে তোমাদের শিশুদের ঘরের বাইরে বের হওয়া থেকে বারণ করাে। কেননা এ সময় শয়তানরা তাদের ফিতনা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে। এক প্রহর অতিক্রান্ত হয়ে গেলে শিশুদের ছেড়ে দাও এবং ঘরের দরজাগুলো বন্ধ করে দাও। দরজা বন্ধ করার সময় আল্লাহর নামে বন্ধ করবে। কারণ আবদ্ধ দরজা শয়তান খুলতে পারে না। ঘরের বাসন-কোসন গুলো ঢেকে রাখবে। ঢেকে রাখার সময় আল্লাহর নাম নিয়ে ঢেকে দেবে, পাত্রে কোন কিছু থাকুক বা না থাকুক।

শয়তানের অনিষ্ট থেকে বাঁচতে কবুতর রাখার পরামর্শ

হযরত হাসান বসরী (রা.) বলেন, নবী করিম (সাঃ) এরশাদ ফরমান “পালক কাটা কবুতর তোমরা ঘরে রাখ। কেননা এরা তােমাদের শিশু সন্তানকে রক্ষার জন্য শয়তানকে তাদের সাথে ব্যস্ত রাখতে সহায়তা করবে । হযরত কায়েস ইবনে আবু হাসেম বলেন, যে কোন বিছানা বিছিয়ে রাখা হয় এবং এতে কেউ শয়ন না করলে শয়তান উক্ত বিছানায় শয়ন করে।

মানুষের মত জিনরাও শরীয়তের আওতাভুক্ত। শরীয়তের বিধি-বিধান তারা মানতে বাধ্য, যেমন বাধ্য মানুষ। তারাও জান্নাতে বা জাহান্নামের বাসিন্দা হবে। জিন বা শয়তানের নির্ধারিত কোন দেশ নেই। তবে তারা মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর এক প্রান্তের খবর অন্য প্রান্তে পৌঁছাতে সক্ষম। আল্লাহ আমাদের সবাইকে জিনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করুক।

ইসলামের আলোকে জিন জাতির ইতিহাস (পর্ব ১)

ইসলামের আলোকে জিন জাতির ইতিহাস (পর্ব ২)

সূত্রঃ জিন ও শয়তানের ইতিকথা।

Share this post on..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *